top of page

বিপ্লবী কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা- স্টিভ ব্রাউয়ার

  • Writer: People's News Indie
    People's News Indie
  • Mar 19, 2020
  • 22 min read

Updated: Apr 7, 2021

বিপ্লবী কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা- স্টিভ ব্রাউয়ার ‘অনেক সময়ই আমাদের ধারণাগুলোকে পাল্টাতে হয়। শুধু সাধারণ ধারণা কিংবা সামাজিক বা দার্শনিক ধারণাই নয়, মাঝে মাঝে আমাদের চিকিৎসা সম্পর্কিত ধারণাও পাল্টাতে হয়।’- চে গেভারা

‘বিপ্লবী চিকিৎসা প্রসঙ্গে’, ১৯৬০ ‘সবার জন্য চিকিৎসার লক্ষ্য অর্জন করতে কিউবার মতো দৃঢ় পদক্ষেপ আর কোনো দেশই নেয়নি’- ডা. হাফসন মাহলার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরিচালক, ২০০০ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং নতুন চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিউবার অসাধারণ সফলতা আসতে কয়েক দশক সময় লেগেছে। এই কাজে কিউবা ভেনিজুয়েলাসহ বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু কেমন করে কিউবার মতো তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও ছোট একটি দেশ এই অঙ্গীকার পূরণ করার সামর্থ্য অর্জন করল, তা অনুধাবন করতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে কেমন করে কিউবা তার নিজের চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে মানবসম্পদ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও সামাজিক দক্ষতা তৈরি করেছে। ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পরপরই কিউবা তার চিকিৎসাসেবা প্রদানের ধরন-ধারণে পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাসেবার ওপর জোর দিতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে সমাজজীবনের সাথে পারিবারিক চিকিৎসাসেবার সার্বিক সমন্বয়কে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে চিকিৎসা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণেও পরিবর্তন আনা হয়। প্রথম শ্রেণির চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার আকক্সক্ষার কোনো কমতি ছিল না কিউবার। কিন্তু কিউবাকে প্রায়ই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে, ফলে কিউবাকে এই নতুন স্বাস্থ্যসেবার নকশা তৈরি ও বাস্তবায়নের কাজটি করতে হয়েছে একটি উন্নয়নশীল দেশের সীমিত সামর্থ্যরে গণ্ডির মধ্যে থেকেই। এ কারণে কিউবাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেই সাথে সর্বজনীন চিকিৎসার প্রতি তার দার্শনিক দায়বদ্ধতায়ও অবিচল থাকতে হয়েছে। নিজের দেশের সকল মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম এ রকম একটি চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে বলেই কিউবা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোকে এ বিষয়ে যাথাযথ সাহায্য ও প্রশিক্ষণ প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিউবার বিনা মূল্যে সর্বজনীন চিকিৎসাব্যবস্থা বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের জন্য তো বটেই, এমনকি অনেক উন্নত দেশের কাছেও ঈর্ষণীয় একটা অর্জন। শিশুমৃত্যুর হার কিংবা পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড় আয়ু ইত্যাদি বিভিন্ন পরিসংখ্যানের বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিচারেও কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থার সফলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, একইভাবে কিউবার শিক্ষাব্যবস্থার সামর্থ্যও স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন আমরা দেখি দুনিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় কিউবার মাথাপিছু চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। ২০০৯ সাল নাগাদ কিউবার মোট চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪৮৮০, অর্থাৎ প্রতি ১৫০ জন নাগরিকের জন্য ১৫ জন চিকিৎসক, যা পশ্চিম ইউরোপে ৩৩০ জনে ১ জন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪১৭ জনে ১ জন। (সূত্র : ১) বিপ্লবের আগে ১৯৫৮ সালে কিউবার চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ৬০০০, অর্থাৎ ১০৫১ জনের জন্য ১ জন চিকিৎসক। এই অনুপাত বেশির ভাগ ল্যাটিন আমেরিকার দেশের তুলনায় বেশি ছিল। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, যখন বহু চিকিৎসক কিউবার বিপ্লবী সমাজে চিকিৎসা পেশা চর্চা না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কিউবা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে চলে যান অন্য দেশে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে দেখা গেল, আগের অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র তিন হাজার চিকিৎসক আছেন কিউবায় এবং বিভিন্ন বাস্তব কারণে তাঁদের শূন্যস্থান পূরণের প্রক্রিয়াটিও বেশ ধীরগতির। ১৯৫৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব হাভানা মেডিক্যাল স্কুল যখন পুনরায় চালু হলো (স্বৈরশাসক বাতিস্তা ১৯৫৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিয়েছিলেন), ১৬১ জন অধ্যাপকের মধ্যে মাত্র ২৩ জনকে শিক্ষাদানের জন্য পাওয়া গিয়েছিল। (সূত্র : ২) এই সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিপ্লবী সরকার যত দ্রুত সম্ভব কিউবার সকল নাগরিককে চিকিৎসাব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে জোর দেয়। সকল বেসরকারি বিমা, চিকিৎসাসেবা ও হাসপাতালকে একটা জাতীয় জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতার মধ্যে আনা হয়। ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দ্রুত রাষ্ট্রীয় করা হয়। চিকিৎসা ফি ক্রমশ হ্রাস করতে করতে একেবারে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা চালু করা হয়। সর্বজনের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এই চেষ্টা ১৯৫৯ সালে হাভানা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ অস্থিরতা তৈরি করে। শেষ বর্ষের ছাত্ররা অনেকগুলো ঝোড়ো মিটিংয়ে বসেন। (সূত্র : ৩) অতীতে চিকিৎসাবঞ্চিতদের মধ্যে ইন্টার্ন করতে তাঁরা বাধ্য কি না, সে বিষয়ে অনেক তর্ক হতে থাকে। অনেকে শহরেই থাকতে চাইলেন, আগের নিয়মে চিকিৎসা ব্যবসা করার প্রশিক্ষণ নিতে চাইলেন। কিন্তু বেশির ভাগই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কিউবার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যেখানকার চাষিরা কখনোই চিকিৎসাসেবার আওতায় ছিল না। সে অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সদ্য পাস করা চিকিৎসকদের জন্য পল্লি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ৩১৮টি নতুন পদ সৃষ্টি করল, যার বেশির ভাগই ছিল সিয়েরা মায়েস্ত্রার মতো সুদূর পার্বত্য এলাকায়। এই উদ্যোগটি ছিল ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের জন্য একটি মডেল। ফলে ষাটের দশকের শেষের দিকে এসে সকল চিকিৎসককে এমন একটি সর্বজনের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়, যেখানে সবার জন্য চিকিৎসা একেবারে বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। এর পরের বছর চে গুয়েভারা বিপ্লবী চিকিৎসা প্রসঙ্গে একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি পল্লি এলাকায় চিকিৎসা দিতে অনিচ্ছুক চিকিৎসকদের সম্পর্কে তাঁর ভাবনা তুলে ধরেন। বিপ্লবে ও দরিদ্র জনগণের প্রতি সংহতির অভাবের জন্য এই চিকিৎসকদের সস্তা সমালোচনা করার বদলে চে বললেন যে এঁদের অনিচ্ছার পেছনে শুধু লোভ নয়, ভিন্ন কিছু ব্যাপারও কাজ করছে। চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে স্রেফ নিজের ব্যক্তিগত মহিমা অর্জনের ভাববাদী স্বপ্ন এবং বিপ্লবী সংহতির জীবন গ্রহণের ব্যাপারে নিজের প্রস্তুতিহীনতার কথা স্বীকার করে তিনি বললেন : ‘কয়েক মাস আগে এই হাভানায় দেখা গেল, সদ্য পাস করা একদল চিকিৎসক দেশের গ্রাম এলাকায় যেতে চাইছেন না এবং যেতে রাজি হওয়ার আগেই পারিশ্রমিক চেয়ে বসেছেন। অতীতের বাস্তবতা মাথায় রাখলে এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে যৌক্তিক বিষয়-অন্তত আমার তা-ই মনে হয়; কারণ আমার কাছে ব্যাপারটা একেবারে পরিষ্কার। এই পরিস্থিতি আমাকে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়- অতীতে কী ছিলাম এবং কয়েক বছর আগেও কী আকাক্সক্ষা পোষণ করতাম। আমি যখন চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে শুরু করি, তখন আমার মাথায় আদর্শ হিসেবে আজকের দিনের বেশির ভাগ বিপ্লবী ধারণাগুলো ছিল না। আর সবার মতো আমিও সফলতা চাইতাম। স্বপ্ন দেখতাম চিকিৎসাশাস্ত্রে বিখ্যাত গবেষক ও বৈজ্ঞানিক হব, স্বপ্ন দেখতাম অবিরাম পরিশ্রম করে যেন এমন একটা কিছু আবিষ্কার করতে পারি, যা মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগবে, কিন্তু তা আমার জন্য নিয়ে আসবে ব্যক্তিগত জয়। আমি ছিলাম আর সবার মতো আমার পরিবেশেরই সন্তান।’ চে সেদিন বলছিলেন, ব্যক্তিগত মহিমা অর্জনের ভাববাদী স্বপ্ন শিক্ষার্থীদেরকে সামাজিক সংহতির জন্য প্রস্তুত করে না। ফলে কিছু তরুণ চিকিৎসক যে বিপ্লবের মধ্যে বসবাস করেও বিপ্লবের প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারেননি, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে ওই তরুণ শিক্ষার্থীরা কিউবা ছেড়ে যাওয়ায় কিউবাকে ওই সময় স্রেফ হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেডিক্যাল স্কুলের মাধ্যমে তাঁদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুনদের শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে হয়েছিল। চের পুরনো বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডো এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। আর্জেন্টিনার নাগরিক আলবার্তো মোটরসাইকেলে করে চের ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন। জৈব রসায়নের ডিগ্রিধারী গ্রানাডো ল্যাপরোসি রোগের নিরাময়ের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি বিপ্লবী কাজে সহায়তা করতে কিউবায় চলে আসেন। ১৯৬২ সাল নাগাদ তিনি কিউবার একদল চিকিৎসককে সাথে নিয়ে হাভানা থেকে ৫০০ মাইল দূরে সান্টিয়াগো ডি কিউবায় দ্বিতীয় চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করেন। মাত্র ৬৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি মেডিক্যাল স্কুলে ৪৫ বছর পর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৩৩৩ জন, যার মধ্যে দুটি স্কুলে চিকিৎসাবিদ্যা আর বাকি তিনটিতে নার্সিং, দন্ত চিকিৎসা এবং এসবের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান-বিষয়ক পাঠদান করা হয়। ২০০৮ সাল নাগাদ কিউবার মেডিক্যাল স্কুলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫, যেখানে পড়ছেন ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে মেডিক্যাল স্কুল, দন্ত চিকিৎসা, নার্সিং, চিকিৎসা প্রযুক্তি, পুনর্বাসনসহ চিকিৎসাবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার। তবু ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাতটি বিপ্লব-পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছতে। যদিও এই অনুপাত ১৯৫৮ সালের চেয়ে বেশি ছিল না, কিন্তু তত দিনে কিউবার চিকিৎসা বিতরণ ব্যবস্থা মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে, যেহেতু চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীকে সারা দেশে আগের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত করা হয়। নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতায় সব চিকিৎসাবঞ্চিত এলাকায় চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়, জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে জোর দেওয়া হয় এবং সকল নাগরিককে এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে নিয়ে সরকারি প্রচারণার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে সর্বসাধারণের মাঝে উঁচুমাত্রায় সচেতনতা তৈরি করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে যেসব চিকিৎসক পল্লি চিকিৎসাসেবার আওতায় একেবারে প্রথম দিকে কিউবার পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে গিয়েছিলেন, তাঁরা বহু বছর পরে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় পেছন দিককার কথা স্মরণ করে বলেছেন, সে সময়কার অভিজ্ঞতা নতুন চিকিৎসাব্যবস্থা চর্চায় তাঁদেরকে প্রস্তুত করতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সাক্ষাৎকারদাতাদের কথায় তাঁদের অভিজ্ঞতার একটা সাধারণ গতিপথ ফুটে ওঠে : প্রথম দিকে ‘চিকিৎসকরা জনগণের কুঁড়েতে বসবাস করেন’ এবং ‘তাঁদের ভূমিকা শুধুমাত্র অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেহেতু প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক রোগী তাঁদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসত’। পরে, সময়ের সাথে সাথে, ‘চিকিৎসকরা যতই কমিউনিটির সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকেন, ততই তাঁদেরকে সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।’ (সূত্র : ৪) পরবর্তী কয়েক দশকে এই চিকিৎসকদের অনেকেই কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন; দরিদ্রদের মধ্যে বসবাস করার প্রথম দিককার অভিজ্ঞতা এবং তাদের রোগের উৎসগুলো সম্পর্কে অর্জিত ধারণা পরবর্তীতে কিউবায় প্রতিরোধমূলক এবং প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর সর্বজনীন গুরুত্ব আরোপের নৈতিক ভিত্তিটা তৈরি করে দেয়। সত্তরের দশকে স্থাপিত স্থানীয় পলিক্লিনিকগুলো ‘কম্প্রিহেনসিভ কমিউনিটি চিকিৎসাসেবা’র মূল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর জোর দিয়ে কমিউনিটি চিকিৎসা কার্যকরভাবে গোটা দেশের জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়। চিকিৎসক, নার্স ও অন্য চিকিৎসা পেশাজীবীরা যেন সুস্থ-সবল কমিউনিটি তৈরিতে তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারেন সে জন্য ১৯৭৬ সালে চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা দেখভালের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করে : ‘ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের চিকিৎসকেরা শুধু হাসপাতাল কেন্দ্র করে শিক্ষিত হন, তাঁদের ঝোঁক থাকে রোগের কারিগর হয়ে ওঠার দিকে। স্বাস্থ্যের সামাজিক, মানসিক কিংবা পরিচ্ছন্নতা-রোগতাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ থাকে না তাঁদের...প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে মনোযোগ থাকে অবহেলিত...বহু দশক ধরেই বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থার দিকে অতিরিক্ত জোর দেওয়ার প্রবণতা চালু আছে...এই সব খোদ মানুষ সম্পর্কিত ধারণাটিকেই বিকৃত করে ফেলেছে।’ (সূত্র : ৫) পলিক্লিনিকগুলোকে প্রাথমিক চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরবর্তী কয়েক দশকে চিকিৎসা শিক্ষার প্যারাডাইম এবং স্বাস্থ্যসেবার দর্শনটিকেই পাল্টে ফেলতে হয়েছে। কিউবার চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যখন তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাসের কথা স্মরণ করেন, তখন প্রায় সব সময়ই ১৯৭৮ সালে আলমা আতায় গৃহীত গাইডলাইনের কথা তুলে ধরেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানের কাজাখস্তান) আলমা আতায় প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল কর্তৃক জারি করা রিপোর্টে ওই সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশিত হয়। সম্মেলনে সকল দেশে এবং বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সর্বজনীন প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক এজেন্ডা স্থির করা হয়। রিপোর্টে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবানির্ভর একটি নতুন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থার আওতায় পারিবারিক চিকিৎসকদের জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি এবং প্রতিরোধমূলক শিক্ষাকে চিকিৎসার সাথে সমন্বিত করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। (সূত্র : ৬) সম্মেলনের পরপর সারা দুনিয়ার চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং মেডিক্যাল স্কুলগুলোর মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এই কাতারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো উন্নত দেশেগুলোও রয়েছে, যেখানে বিশাল গ্রাম্য এলাকা এবং দরিদ্র নগর কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসাকর্মীর মারাত্মক সংকট রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এই তাগিদ আস্তে আস্তে সারা দুনিয়ায়ই দুর্বল হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশগুলোতে উদ্যোগটি দুর্বল হয় ‘স্বাস্থ্যসেবা বাজার’-এর মুনাফার আকর্ষণে আর উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে উদ্যোগটি দুর্বল হয় সর্বজনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা-বিরোধী নয়া উদারনৈতিক নীতিমালার চাপে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. হাফদান মাহলার ২০০৮ সালে আলমা আতা ঘোষণার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন, “বেশির ভাগের কাছে এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী চিন্তা। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এমন একটা মূল্যবোধভিত্তিক ব্যবস্থা (ভ্যালু সিস্টেম), যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা হলো কৌশলগত উপাদান। এর একটা আরেকটার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।” তিনি মনে করেন, জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে সেই সময় বৈশ্বিক ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল কারণ ‘১৯৭০-এর দশকের সময়টা ছিল সামাজিক ন্যায়ের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাল। এ কারণেই ১৯৭৮ সালে আলমা আতার পরে সব কিছুই সম্ভব বলে মনে হতে থাকে।’ পরবর্তীতে যখন সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে সমন্বিত চিকিৎসার ধারণাটা খুব দ্রুত দুনিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে পরিত্যক্ত হয়, সেটাও ঘটে ‘একটা পুরো উল্টো যাত্রার কারণে, যে সময় আইএমএফ স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম বা কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচির মাধ্যমে সব ধরনের বেসরকারীকরণকে উৎসাহিত করে। আইএমএফ সে সময় আলমা আতায় গৃহীত ঐকমত্যের সমালোচনা করে এবং প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রিক কৌশলের প্রতি অঙ্গীকারকে দুর্বল করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় থাকা বিভিন্ন অঞ্চল চেষ্টা করলেও বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি।’ (সূত্র : ৭) কিউবা কিন্তু আলমা আতা রূপকল্পের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে এবং সেই রূপকল্পকে বাস্তবে পরিণত করতে তার চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রতি দশকেই বিভিন্ন উপাদান যুক্ত করতে থাকে। কিউবার প্রতিটি প্রদেশে মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন করার কারণে ১৯৮০-র দশকে জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আরো বেশিসংখ্যক যোগ্য প্রাথমিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়। ১৯৮৪ সালে এসে ফিডেল ক্যাস্ট্রো ঘোষণা করেন, ২০০০ সাল নাগাদ কিউবায় ৭৫ হাজার চিকিৎসক তৈরি হবে, কিউবার প্রয়োজন মিটিয়েও যাঁদের মধ্য থেকে ১০ হাজার জনকে যে কোনো সময় দেশের বাইরে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত করা সম্ভব হবে। ১৯৮৬ সালে লক্ষ্যমাত্রা আরো নিখুঁত করার জন্য চিকিৎসকের সংখ্যা ৬৫ হাজারে নির্ধারণ করা হয়, যে লক্ষ্যমাত্রা শতাব্দীর শুরুতে অর্জিতও হয়। এ সময় কিউবায় চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৬ হাজারে। বিস্ময়কর এক পরিবর্তন- ১৯৭৬ সালে প্রতি হাজারে মাত্র ১ জন চিকিৎসক থেকে ২৪ বছর পর প্রতি ১৬৭ জনে ১ জন চিকিৎসক। ১৯৮৪ সালে কিউবার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা বিস্তারের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে আরো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ‘মেডিসিনা জেনারেল ইন্টিগ্রাল’ নামে পারিবারিক চিকিৎসার একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়, ইংরেজিতে যা ‘কম্প্রিহেনসিভ জেনারেল মেডিসিন’ নামে পরিচিত। ৮০-র দশকের শেষের দিকে এই কর্মসূচির মাধ্যমে কম্প্রিহেনসিভ জেনারেল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ এবং একজন করে চিকিৎসক ও নার্স সমন্বয়ে বেসিক হেলথ টিম তৈরি হতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকজুড়ে এই চিকিৎসক দলগুলোকে কিউবার প্রতিটি এলাকায় চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত করা হয়। এই দলগুলোকে সহায়তা করে ‘ব্রিগেডিস্টাস স্যানিটারিয়াস’ বা স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে গঠিত কতগুলো স্বাস্থ্য ব্রিগেড। এই স্বাস্থ্য ব্রিগেডগুলো চিকিৎসক ও নার্সদের সাথে প্রায়ই সাক্ষাৎ করে। বিশেষ করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার বিকাশে ও জনস্বাস্থ্যের প্রচারণায় স্বাস্থ্য ব্রিগেডগুলো মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। ২০০৪ সাল নাগাদ এই চিকিৎসক দলগুলো কিউবার ৯৯ শতাংশ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। একেকটি দলের কাজের আওতায় পড়ে গ্রাম বা শহরের ১২০ থেকে ১৫০ পরিবারের প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ জন মানুষ। চিকিৎসক ও নার্সরা নিজ নিজ কাজের এলাকায়ই থাকে, যেন প্রয়োজনের সময় দ্রুত প্রতিটি পরিবারের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। এই আয়োজনটি প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি; কেননা এই ব্যবস্থায় চিকিৎসক দলগুলোর পক্ষে স্থানীয় এলাকাটির সবচেয়ে জরুরি চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়গুলো অনুধাবন করার সুযোগ তৈরি হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে এবং তারপর প্রতিরোধমূলক সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে চিকিৎসক ও নার্সদের দল কিউবার নাগরিকদের আরো বেশি স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলে। ফলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। প্রয়োজনে চিকিৎসক বা নার্সদের দল রোগীদেরকে ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্য পলিক্লিনিকের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এবং রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রেরণ করে। এরপর প্রয়োজন অনুসারে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি কিংবা সার্জারির ব্যবস্থা করে। পলিক্লিনিকগুলোর অবস্থান এমন একেকটা জায়গায়, যেখান থেকে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষ এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক বা নার্সদেরকে সাহায্য করতে পারে। একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারিবারিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের একটি দল ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক পর্যন্ত কিউবার প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার একটি মূল্যায়ন তৈরি করে। তারা কিউবার চিকিৎসক ও নার্সদের দলের অভূতপূর্ব মনোযোগের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরে। তারা দেখে, চিকিৎসক ও নার্সরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের সকলকে আক্ষরিক অর্থেই চেনে-জানে। তারা এ বিষয়ে লিখেছে, ‘প্রত্যেক পারিবারিক চিকিৎসককে বছরে অন্তত দুবার নিজ নিজ কর্মএলাকার প্রত্যেক রোগীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়। চিকিৎসকদের কাছে নিজ নিজ এলাকার সকল রোগীর অবস্থা এবং তাদেরকে দেওয়া প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাসেবার রেকর্ড থাকে।’ তারা এমন কিছু বিষয়ের বর্ণনা দেয়, যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাব্যবস্থার ভোক্তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে : ‘রোগীকে যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, পারিবারিক চিকিৎসক নিজ উদ্যোগে সেখানে যান। রোগী যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি হয়েছে, তার সাথে সাক্ষাৎ করেন, হাসপাতালের চিকিৎসার সাথে পরিচিত হন, যেন হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পর সে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তিনি রোগীর সাথে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করেন, যেন রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়।’ (সূত্র : ৮) ‘পারিবারিক চিকিৎসক-নার্স সংবলিত চিকিৎসা কর্মসূচি’ বাড়ানোর সাথে সাথে চিকিৎসার পাঠক্রমেও পারিবারিক চিকিৎসার মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। ১৯৯০-এর দশকের দিকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রায় সকল চিকিৎসা শিক্ষার্থীকে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জনের আগে প্রথমে পারিবারিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যার মধ্যে অন্তত তিন বছরের আবাসিক চিকিৎসাও অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসায় দক্ষতা অর্জনের ওপর এই গুরুত্বারোপের ফলে শুধু যে কিউবার ভেতরেই পারিবারিক বা সামাজিক চিকিৎসার প্রাধান্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তা নয়, সেই সাথে কিউবার চিকিৎসা স্বেচ্ছাসেবীদেরকে কিউবার বাইরের বিভিন্ন চিকিৎসা ঘাটতির দেশে চিকিৎসাসেবা প্রদানে নানাভাবে যোগ্য করে তোলা হয়। প্রত্যেক চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় পারিবারিক চিকিৎসাসেবা প্রদানে সক্ষম, সেই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করা প্রচুর চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা প্রয়োজনানুসারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা দিতেও সক্ষম। ড. ইলিয়েনা ডেল রোসারিও মোরালেস সুয়ারেস, ড. হোসে অ্যা. ফার্নান্দেজ সাকাসাস ও ড. ফ্রান্সিসকো ডুরান গারসিয়ার কাছ থেকে ওই সময় কিউবার চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব ধারণাগত পরিবর্তন হয় তার একটা রূপরেখা জানা যায়। প্রত্যেক চিকিৎসককে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় দক্ষ করে তোলার জন্য সে সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয় : ১. চিকিৎসাকে সামাজিক-জৈবিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত এক বাস্তব জীবন পদ্ধতি হিসেবে দেখা; ২. সমস্যাভিত্তিক এবং পারস্পরিক আলোচনানির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করা; ৩. রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ওপর বেশি করে জোর দেওয়া; ৪. প্রশিক্ষণের শুরুর দিকেই বিভিন্ন মেডিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সূত্রপাত ঘটানো; ৫. অধ্যাপকদের পাঠদান পদ্ধতির ক্রমাগত উন্নয়ন ঘটানো এবং শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বলা; ৬. প্রত্যেক মেডিক্যাল স্কুলে কম্প্রিহেনসিভ জেনারেল মেডিসিনের পৃথক বিভাগ খোলা বাধ্যতামূলক করা; ৭. তাত্ত্বিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস বাধ্যতামূলক করা, যার মাধ্যমে পারিবারিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার প্রমাণ মেলে। (সূত্র : ৯) বিশেষ আমলে স্বাস্থ্যসেবা: ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কিউবার অর্থনীতি শতকরা ৪ ভাগ হারে বাড়ে। ফলে ওই পর্যায়টি ছিল চিকিৎসক ও নার্সদের দলসহ কিউবার প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থার ক্রমাগত বিকাশ এবং কম্প্রিহেনসিভ জেনারেল মেডিসিনের আওতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ একটা সময়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে কিউবার অর্থনীতি একটা ‘বিশেষ পর্যায়ের’ মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই কঠিন একটি দশকে শুধু কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থাই না, খোদ বিপ্লবই হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সাথে কিউবার ব্যবসা-বাণিজ্য ভেঙে পড়ায় কিউবার রাপ্তানি কমে ৭৬ শতাংশ এবং ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩- এই চার বছরে জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পায় ৩৫ শতাংশ। জনগণকে জীবনযাত্রায় মারাত্মক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, যেমন- জ্বালানির স্বল্পতার কারণে বহু কিউবাবাসীকে বাস ও গাড়ির বদলে সাইকেল ও ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করতে হয়, ট্রাক্টরের বদলে চাষাবাদের কাজে ষাঁড় ব্যবহার করতে হয়। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সাল নাগাদ খাদ্যঘাটতি এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যে জনগণের ক্যালরি গ্রহণের গড় হার কমে যায়, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার অন্তত ২৫ শতাংশ কমে যায়। শুধুমাত্র কঠোর রেশনিংয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানকারী মায়েদের সুষম খাদ্য এবং শিশুদের প্রয়োজনীয় দুধ ও প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতভাগ জোগান দেওয়া সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস পুরো পরিস্থিতি আরো দুর্বিষহ করে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিল। তারা ১৯৯২ সালে টোরেচেলি আইন নামের একটি আইন পাস করে, নোংরামি করে যার নাম দেওয়া হয় ‘কিউবা ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট’! কিউবার পুরো সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোকে কিউবা এবং কিউবায় ব্যবসা করে এমন সব কোম্পানির বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে নির্দেশ জারি করা হয়। মার্কিন কোম্পানিগুলোর সাথে কিউবার বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী বিষয়ক। টোরেচেলি আইনের ফলে তাই কিউবায় বিদ্যমান ঔষধসামগ্রীর সংকট আরো ঘনীভূত হয়। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে বিশেষ পর্যায়ের সংকট আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে, এ সময় কিউবার ওষুধের দোকানগুলোতে ১২০০ বহুল ব্যবহৃত ওষুধের মধ্যে অর্ধেকেরই জোগান বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে মানুষের কষ্ট আরো বেড়ে যায়, যার উদাহরণস্বরূপ শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৯৩ সালে প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংকট এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে ৫০ হাজারেরও বেশি কিউবার নাগরিক অপটিক নিওরোপ্যাথি নামের এক মহামারীতে আক্রান্ত হয়। ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চোখ ও স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক সমস্যা হয়। (সূত্র : ১০) সার্বিকভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক, যন্ত্রপাতি, পাঠ্যবই ও অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি তৈরি হয়, যেমন-স্রেফ এক্স-রে ফিল্ম ও খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে কিউবায় এক্স-রের সংখ্যা আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ কমে যায়। এই সংকটের মুখে কিউবার সরকার প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অক্ষুণ্ণ রাখে এবং পারিবারিক চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অথচ ওই সময়ে গোটা জাতি এমন একটা অর্থ সংকটের মধ্যে ছিল যে এমনকি সমন্বিত চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যবই মুদ্রণের সামর্থ্য পর্যন্ত ছিল না। ১৯৯০-এর দশকে ১৯৭০-এর সময়কার তুলনায় চার গুণ চিকিৎসক তৈরি হয়; ১৯৮৫ সাল নাগাদ সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি পারিবারিক চিকিৎসক চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন; ২০০০ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১ হাজার, যাদের সাথে ছিল সমসংখ্যক সেবিকা। বিদেশি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিউবা এই বিশেষ পর্যায়ে রীতিমতো এক ‘মানবিক বিপর্যয়’ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। এর কারণ হিসেবে তারা কিউবার স্বাস্থ্য দলগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় এলাকাগুলোতে সমন্বিত ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাসেবা প্রদানের নতুন পদ্ধতিটির দ্রুত বিকাশের কথা উল্লেখ করেছেন। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি দুটো বছরের জন্য স্বাস্থ্য সূচকগুলো সাময়িকভাবে খারাপ হলেও গোটা দশকজুড়েই মৃত্যুর হার হ্রাস পায় এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য সূচকগুলো ১৯৮০-র দশকের তুলনায় আরো ভালো হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার ছাড়াও অন্য আরো কর্মসূচির ফলে কিউবায় ‘সুস্বাস্থ্যে’র ধারণাটিই পাল্টে যেতে থাকে। হাসপাতালগুলোতে প্রসূতিদের আগের চেয়ে বেশি সময় থাকতে এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়টিতে তুলনামূলক ভালো খাবার গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সন্তানকে তখনো বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের হার ১৯৯০ সালে ছিল ৬৩ শতাংশ, ১৯৯৪ সালে যা বেড়ে ৯৭ শতাংশে উন্নীত হয়। মাংসের সংকটের কারণে গড়ে বেশির ভাগ মানুষই আমিষ সংকটে ভুগেছে, যদিও এর একটা স্বাস্থ্যকর দিকও ছিলÑতাদের চর্বি গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। রাসায়নিক সার ও জ্বালানি সংকটের কারণে খাদ্য উৎপাদন যতই স্থানীয় পর্যায় কেন্দ্রিক হতে থাকে, ততই ছোট আকারের শহুরে সমবায়গুলোতে প্রাকৃতিক খাদ্য বা ‘অর্গানিক ফুড’ উৎপাদন বাড়তে থাকে এবং কিউবার জনগণ স্বাস্থ্যকর শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ করতে থাকে। বিশেষ পর্যায়ের পরে হাভানার মতো অনেক স্থানে ‘অর্গানোপোনিকোস’ বা প্রাকৃতিক সামাজিক বাগান তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। আর এখন তো এই বাগানগুলোর মাধ্যমেই শহরের ভোক্তাদের বেশির ভাগ চাহিদা মেটানো হয়। বিশেষ পর্যায়ে যেসব অ্যালোপেথিক ওষুধের সংকট ছিল, সেসবের বিকল্প অনুসন্ধানের একটা তাগিদ থেকে আয়ুর্বেদিক ওষুধের মতো বিকল্প এবং লোকজ চিকিৎসার প্রতি উৎসাহ আরো জোরদার হয়। ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কিউবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একদল বিজ্ঞানীর সংকলন করা ঔষধি গাছগাছড়া থেকে তৈরি ‘মেডিসিনা ভার্দে’ বা ‘সবুজ ওষুধ’ বিষয়ক একটি নির্দেশনা জারি করে। বেশির ভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গাছগাছড়া থেকে তৈরি ওষুধের তালিকা ঝোলানো থাকে, গ্যাস্ট্রিক থেকে শুরু করে মাংসপেশির ব্যথা ইত্যাদি সারাতে কোন কোন ওষুধ কাজে লাগে তা-ও ওই তালিকায় উল্লেখ করা থাকে। বিকল্প চিকিৎসার প্রতি এই যে উৎসাহ, কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থায় তার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। কারণ এই সব বিকল্প চিকিৎসা কিউবার সকল মেডিক্যাল স্কুলের নিয়মিত পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়, যার মধ্যে আকুপাংচাররের মতো ভিনদেশি সংস্কৃতি থেকে গৃহীত চিকিৎসা পদ্ধতিও রয়েছে। ২০০০ সালে কিউবা বিশেষ পর্যায় থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। এ সময় কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থা জীর্ণ ও ক্লান্ত মনে হলেও তা পুরোপুরি অটুটই ছিল। জাতিসংঘের ইউএনডিপি প্রকাশিত মানব উন্নয়ন ও সমতাসংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে : ‘আমেরিকা মহাদেশের ২৫টি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তুলনামূলক বৈষম্যের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় দেশগুলোর মধ্যে কিউবার স্বাস্থ্য পরিস্থিতিই সবচেয়ে ভালো। এই দেশটিই তার সীমিত সম্পদের মধ্য থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিয়োজিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছে।’ (সূত্র : ১১) ডা. ক্ল্যারিভেল প্রেসনো ল্যাবরাডর ও ডা. ফেলিক্স সানসো সোবেরাত নামে কিউবার দুই অধ্যাপক ২০০৪ সালে কিউবার পারিবারিক চিকিৎসা কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই কর্মসূচিসহ বিশেষ পর্যায়ে কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলোর প্রশংসাই করেছেন। সেই সাথে অবশ্য তাঁরা এই বিশেষ পর্যায়ের কঠিন পরিস্থিতিটি কিউবার চিকিৎসা পেশাজীবীদের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, সে দিকটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ রকম দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি মানসিক চাপ সংক্রান্ত, কারণ : ‘পারিবারিক চিকিৎসক ও নার্সরা যে কমিউনিটিতে কাজ করেছেন, সেখানেই বসবাস করেছেন, প্রতিদিন দেখেছেন অর্থনৈতিক সংকট তাঁদের রোগীদের ওপর কী মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, রোগীদের সংকট ও স্বাস্থ্যের ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাবের তাঁরাও ছিলেন অংশীদার।’ তাঁরা লিখেছেন, নতুন শতকে কিউবার অর্থনীতি দিনে দিনে উন্নতি লাভ করছে, এ সময় কিউবার সরকার ও জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘বিপ্লবের মধ্যে বিপ্লব’-এর উদ্যোগটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘গোটা দেশের জনগণের আরো কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাসেবা আরো সহজলভ্য করা এবং স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক মানোন্নয়ন।’ (সূত্র : ১২) কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনর্গঠন: একুশ শতকের সূচনালগ্নে কিউবা দেশে ও বিদেশে তার বিভিন্ন চিকিৎসা কর্মসূচিতে বহুবিধ উদ্ভাবনী চিন্তার সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়। নতুন পাঠক্রম তৈরি করা হয়, যেখানে বিভিন্ন কারিগরি উদ্ভাবনগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং জৈব চিকিৎসার সাথে চিকিৎসা চর্চার সম্পর্ককে আরো সুসমন্বিত করা হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকান স্কুল অব মেডিসিনের ডিন ড. হুয়ান কারিজো ব্যাখ্যা করেছেন কেন পাঠক্রমের পরিবর্তনটি ইএলএএমে (ল্যাটিন আমেরিকান স্কুল অব মেডিসিন) আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে : ‘এক সেমিস্টারে অ্যানাটমি, পরবর্তী সেমিস্টারে মাইক্রোবায়োলজি- এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার বদলে আমরা মরফোফিজিওলজিক্যাল বা সামাজিক-শারীরতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষাটাকে সাজাই। এর ফলে শিক্ষার্থীর পক্ষে কোনো বিষয় আরো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা, সমস্যা সমাধান করা এবং জ্ঞানের সমন্বয় করা সম্ভব হয়। আমাদের কোর্স ডিজাইনটা এমনভাবে করা হয়, যেন শিক্ষার্থীদের কাছে সব কিছু পরস্পর সম্পর্কিত হিসেবে হাজির হয়, শিক্ষার্থী যেন রোগীকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান শিক্ষার গুণগত মানে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়। আমরা দেখেছি, এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানকে আরো ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেন। স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান, গবেষণা ও পেশাদারিত্ব অর্জনের কাজটিও আরো ভালোভাবে করতে পারেন।’ (সূত্র : ১৩) এই ধরনের পাঠক্রম ও প্রশিক্ষণ শুধু ইএলএএমের শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, কিউবার সকল চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীর জন্যই প্রযোজ্য। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, কিউবার বিভিন্ন প্রদেশে ১৭ হাজার কিউবান শিক্ষার্থী ২১টি প্রচলিত চিকিৎসাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানে এবং আরো ১২ হাজার শিক্ষার্থী প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে ২০০৪-০৫ সাল থেকে চালু হওয়া ইউনিভার্সিটি পলিক্লিনিক মেডিক্যাল ট্রেইনিং প্রোগ্রাম (Program de Medicina Polyclinica universitaria) নামের নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠানের আওতায় চিকিৎসা শিক্ষা লাভ করছেন। কিউবার ৪৯৮টি পলিক্লিনিকের ২৯২টিতে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক পাঠদানের কাজটি হয় পলিক্লিনিকেই অবস্থিত ক্লাসরুমগুলোতে। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে- একেকটি পলিক্লিনিকের সাথে সংযুক্ত কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পেশাদার চিকিৎসকের পাশাপাশি শিক্ষার্থী কর্তৃক রোগীর সেবা প্রদান, ক্লিনিকের গবেষণাগার, পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা অর্জন। কারিগরি প্রশিক্ষণের প্রায় ২০ শতাংশ অনুষ্ঠিত হয় হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। সব শেষে ২০০৭-০৮ সালে আরো ১৪ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর (ইএলএএমের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর বাইরে) জন্য এক নতুন ধরনের চিকিৎসক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করার কাজে পলিক্লিনিক মডেলেরই আরেকটি ধরনকে কাজে লাগানো হয়। ‘ল্যাটিন আমেরিকার চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য নতুন কর্মসূচি’ (El NuevoPrograma de Formacion de Madicos Latinoamericanos, NPFML) নামের এই কর্মসূচির আওতায় ৩৬টি দেশের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যার মধ্যে কাশ্মীরে ২০০৫-০৬ সালে কিউবার ত্রাণ কার্যক্রমের পরপর পাকিস্তান থেকে আসা ১ হাজার বিনা মূল্যের শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীও রয়েছেন। নতুন কর্মসূচির আওতায় পাস করা শিক্ষার্থীদেরকে ইএলএএমের চিকিৎসক হিসেবেই ডিপ্লোমা প্রদান করা হবে; যদিও তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসা শিক্ষা লাভ করছেন। কিউবার চারটি ভিন্ন প্রদেশের চিকিৎসা বিভাগের নির্দেশনার আওতায় চারটি স্থানে একগুচ্ছ করে পলিক্লিনিককে চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। স্থানগুলো হলো কিউবার পশ্চিম দিকে পিনার ডেল রিও, মধ্যাঞ্চলে মাতানজাস ও সিয়েনফুয়েগোস এবং পূর্ব দিকে হোলগুয়িন। চিকিৎসা পাঠক্রমের দিক দিয়ে অগ্রগতি ছাড়াও কিউবা বিশেষ আমলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চিকিৎসাব্যবস্থার বিভিন্ন অংশের পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়। অবহেলিত পলিক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোর সংস্কারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হয়। বিনিয়োগ করা হয় কিউবার চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর অর্জিত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিগরি যন্ত্রপাতি সংগ্রহে। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থার জাতীয় পর্যায়ের পরিচালক ড. ক্রিস্টিনা লুনা জোর দিয়ে বলেন, কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থার সাংগঠনিক কেন্দ্র হিসেবে পলিক্লিনিকগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা দিনে দিনে বাড়ছে : ‘২০০৭ সাল থেকে আশা করা হচ্ছে, পলিক্লিনিকগুলো কমিউনিটিগুলোতে বিদ্যমান সব ধরনের চিকিৎসা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।’ এভাবে স্থানীয় আবাসিক এলাকা থেকে পরিচালক ও বিশেষজ্ঞদেরকে একেকটি সুসমন্বিত দলের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাদের কাজ হবে মাতৃসদন, ফার্মেসি, প্রবীণদের চিকিৎসা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদান। পুনরুজ্জীবিত পলিক্লিনিকগুলোর হাতে আরো বেশি করে চিকিৎসাকর্মী তৈরির বড় দায়িত্বটি তুলে দেওয়া হলো এমন এক সময়ে, যখন সারা দুনিয়ায় বসবাসরত ও কর্মরত কিউবার চিকিৎসকের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। এই সংখ্যা এমনকি ১৯৮০-র দশকে ফিডেল ক্যাস্ট্রোর বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিউবার চিকিৎসকদের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকার কারণেই শুধু নয়, ড. লুনার মতে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে কিউবায় বর্ধিত হারে চিকিৎসক তৈরির প্রয়োজনীয়তা আছে। এই কারণটি হলো প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা : ‘আমাদের নিজেদের জনগণের কাছে করা অঙ্গীকার পূরণ করার জন্যই আমাদের আরো ৪২ শতাংশ বাড়তি চিকিৎসক প্রয়োজন।’ (সূত্র : ১৪) চিকিৎসাক্ষেত্রে পলিক্লিনিকের ভূমিকা পুনর্গঠনের সাথে সাথে জনগণকেও বেশ কিছু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে, যা খুব সহজ ছিল না। আগে একেকটি চিকিৎসক-নার্সের দল এত কমসংখ্যক মানুষের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ছিল যে পারিবারিক চিকিৎসকদেরকে জনগণ নিজ পরিবারের সদস্যদের মতোই মনে করত। প্রত্যেক কমিউনিটি চিকিৎসকের সেবার আওতায় থাকা পরিবারের সংখ্যা আগের দ্বিগুণ করে দেওয়ার ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেকটি চিকিৎসক-নার্স দলের দায়িত্বে ১৫০০ বা তারও কিছু বেশি মানুষ পড়ে। বৈশ্বিক মানদণ্ড বিচারে, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এই হার তখনো যথেষ্ট ভালো বিবেচিত হলেও চিকিৎসক-নাগরিক সম্পর্ককে আগের তুলনায় ‘কম ব্যক্তিগত’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পলিক্লিনিকপ্রতি মানুষের সংখ্যাও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আগে প্রতি ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের জন্য একটি পলিক্লিনিক থাকলেও এখন সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার করা হয়েছে। ২০০৫ সালে বোস্টন গ্লোবের এক প্রতিবেদকের কাছে মাতিলদে (৫৬) নামে কামাগুয়ের এক সিনিয়র চিকিৎসক, যিনি বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনেও কাজ করেছেন, ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আগে প্রতিটি কারখানায়, প্রতিটি বিদ্যালয়ে, প্রতিটি প্রাক-বিদ্যালয়ে একজন চিকিৎসক থাকতেন। সে সময় তারা বেশ অব্যবহৃতই ছিলেন। মধ্যবর্তী স্তরের অনেক প্রশাসনিক কাজ থেকে চিকিৎসকদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে চিকিৎসাব্যবস্থাটিকে আগের চেয়ে আরো মেদহীন ও কর্মদক্ষ বলা যেতে পারে।’ তাঁর ব্যাখ্যা অবশ্য হাভানার অনেক নাগরিককেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাঁরা একই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছেন, আগে যে চিকিৎসককে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে কাছে পাওয়া যেত, তাঁর কাছে পৌঁছানো আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়েছে। (সূত্র : ১৫) ২০০৯ সালে যখন আমি হাভানার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলি, তাঁরা বলেছেন, একসময় বেশ কিছু এলাকায় এমন ঘটলেও ধীরে ধীরে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। হাভানাবাসীর মতে, এর কৃতিত্ব মিউনিসিপ্যাল অ্যাসেম্বলিগুলোতে থাকা বিভিন্ন স্থানীয় দল ও প্রতিনিধিদের, যাঁরা চিকিৎসক-নার্স দলের পুনর্গঠনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ চিকিৎসাসেবার জন্য সোচ্চার থেকেছেন। এমনকি ২০ হাজার চিকিৎসক দেশের বাইরে থাকার পরেও দেশের জনগণকে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য কিউবার অভ্যন্তরে যথেষ্টসংখ্যক চিকিৎসক রয়েছেন। ২০০৯ সালের হিসাবে এই সংখ্যা ৫৫ হাজার : প্রতি হাজার নাগরিকের জন্য ৪.৯ জন চিকিৎসক, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিগুণ। জৈব প্রযুক্তি ও তার জৈব ফলাফল: চিকিৎসাক্ষেত্রে কিউবার দক্ষতা প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান কিংবা সামাজিক চিকিৎসক তৈরির সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে আরো বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। কারণ ভ্যাকসিন ও হাইটেক ওষুধের জগতে কিউবার বড় ভূমিকা রয়েছে, বিভিন্ন বিদেশি অংশীদারের সাথেও ওষুধ উৎপাদনের নানা চুক্তি করেছে কিউবা। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন ঘোষণা করল আফ্রিকার বেশির ভাগ অঞ্চল মেনিনজাইটিসের মহামারীর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, কিউবা ও ব্রাজিল তখন টাইপ বি মেনিজোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম একমাত্র ভ্যাকসিনটির ৫ কোটি ডোজ তৈরির জন্য প্রস্তুত। কিউবার বিজ্ঞানীরা হাভানার ফিনলে ইনস্টিটিউটে ভ্যাকসিনটি আবিষ্কার করেন। এরপর ব্রাজিল ও কিউবার যৌথ বিনিয়োগে ২০০৭ সালে এই ভ্যাকসিনটি বিপুল পরিমাণে উৎপাদনক্ষম একটি প্লান্ট চালু করা হয়, যা উন্নয়নশীল দেশের বড় ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সরবরাহে সক্ষম। হাভানার বাইরে অবস্থিত কিউবান সেন্টার ফর মলিকিউলার ইমিউনোলজি (সিআইএম) বেশ কিছু সম্ভবনাময় ক্যানসার প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি করেছে। নিমোটোজুমাব (Nimotuzumab) নামের একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এমনই একটি ওষুধ, যা ঘাড়, গলা ও মস্তিষ্কের টিউমার প্রতিরোধে সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং আরো কিছু জীবনবিনাশী টিউমার প্রতিরোধে যথেষ্ট সম্ভবনাময় বলে চিহ্নিত হয়েছে। ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে এবং ভারত, চীনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগে রোগীদের ওপর প্রয়োগ করার জন্য উৎপাদনও করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল। অবশেষে ২০০৯ সালে ওয়াইএম বায়োসায়েন্সেস নামে কানাডার একটি কোম্পানিকে মার্কিন মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর গবেষকদের সাথে মিলে ওষুধটির ট্রায়াল করার লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ২০০৮ সালে কিউবা ৩৪ কোটি ডলারের জৈব প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে ছিল ১২০০ পেটেন্ট। রপ্তানির এই পরিমাণ তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। কিউবার সেন্টার ফর জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির (CIGB) প্রধান লুইস হেরেরার মতে, জৈব প্রযুক্তি শিল্পের দ্রুত উন্নয়নের পেছনে কিউবার গবেষণা কেন্দ্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে : ‘শুরুতেই বুঝে নিয়েছি, আমরা এত দরিদ্র যে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা আমাদের পোষাবে না।’ (সূত্র : ১৬) সিআইজিবির বহু সফলতার মধ্যে একটি হলো হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার। এই দ্বীপরাষ্ট্রের অধিবাসীদের লিভারের বেশির ভাগ রোগের জন্য দায়ী ছিল ভাইরাসটি। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ৮ বছরের মধ্যে শিশুদের মাঝে এই রোগের প্রকোপ একেবারে শূন্যে নেমে আসে। আন্তর্জাতিক হাইটেক ড্রাগ উৎপাদনের জগতে যথেষ্ট সমীহ অর্জনকারী এই গবেষণা সংস্থাগুলোর যাত্রা শুরু ১৯৮০-র দশকে। ১৯৯০-এর দশকের বিশেষ আমলে অর্থনৈতিক মন্দা এবং স্পর্শকাতর গবেষণা, যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সংকটের মধ্যেও এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। বস্তুগত সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব প্রায়ই হতো, কিন্তু মানবসম্পদের বিকাশ অব্যাহত রাখার দূরদৃষ্টি কিউবার সরকারের ঠিকই ছিল। মানবসম্পদের বিকাশের জন্য আরো বেশি করে গবেষক-বিজ্ঞানীদের উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। মূলত পশ্চিম হাভানার একটি এলাকায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল। বিশেষ আমলের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সময় কিউবার এই গবেষণা কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানি যৌথ বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। আজ জৈব প্রযুক্তি শিল্প কিউবার বৈদেশিক বাণিজ্যের এতটাই গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে যে বিজ্ঞানী, অধ্যাপক ও ব্যবসায়িক উদ্ভাবকদের মধ্যে নতুন ধরনের সহযোগিতার বিকাশ ঘটাতে কিউবার ১২টি প্রদেশে সায়েন্টিফিক পোল বা বৈজ্ঞানিক মেরু নামে পরিচিত বহু গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কিউবা বেশ ভালো করেছে। কিন্তু কিউবার মতো তুলনামূলক দরিদ্র একটি দেশের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতে রীতিমতো ধনী দেশের মতো ফলাফল অর্জন করার মূল কারণ তা নয়। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের সুস্থতার প্রতি ধারাবাহিক মনোযোগের কারণে, যা এমনকি খাদ্য সংকটের দিনগুলোতেও অটুট ছিল। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সত্ত্বেও কিউবার পক্ষে বড় বড় মার্কিন চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে যে ধরনের স্পর্শকাতর চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, সে ধরনের চিকিৎসা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্থোপেডিক সার্জারিসহ বিভিন্ন বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য কিউবার চমৎকার আয়োজন থাকলেও কিউবার পক্ষে প্রায়শই ধনী দেশগুলোতে তৈরি নতুন নতুন ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয় না। মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের ফলেও অনেক অত্যাবশকীয় ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা কিউবার পক্ষে অসম্ভব কিংবা দুরূহ হয়ে ওঠে। এই ঘাটতির পরেও কিউবার গড় আয়ু ও মৃত্যুর হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনীয়। নারী-পুরুষের গড় আয়ুর দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে সমান্য এগিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী-পুরুষের গড় আয়ু ৭৯ বছর এবং কিউবায় ৭৮ বছর। কিন্তু সদ্য ভূমিষ্ঠ ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে কিউবায় সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১১ থেকে ৫-এ নেমে এসেছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ১০ থেকে কমে ৭-এ এসেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারও কিউবায় অর্ধেকের বেশি হ্রাস পেয়ে ১৩ থেকে ৬-এ নেমেছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ১১ থেকে ৮-এ নেমেছে। (সূত্র : ১৭) হাভানার ইমিউনোএসে সেন্টারের (Immunoassay Center) পরিচালক ডাক্তার হোসে লুইস ফার্নান্দেজ ইয়েরো কিউবার কমিউনিটিভিত্তিক চিকিৎসার কার্যকারিতার কারণ সংক্ষেপে খুব স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন : সুস্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারকগুলোর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দরিদ্র, অশিক্ষিত ও প্রান্তিকভাবে বসবাসরত মানুষ অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের তুলনায় বেশি অসুস্থ হয় ও মৃত্যুবরণ করে। এ থেকে বোঝা যায়, সর্বত্র উপযুক্ত প্রযুক্তির সহায়তায় প্রতিরোধমূলক কৌশলের মাধ্যমে এই মানুষদের স্বাস্থ্যরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা অনুসারে, টেকসই স্বাস্থ্য যতটা জটিল প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাজারনির্ভর বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপিত নিত্যনতুন মডেলের পণ্যের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে স্বাস্থ্যরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের ওপর, নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক অবস্থার উপযুক্ত প্রযুক্তির আওতায় বিশালসংখ্যক মানুষকে নিয়ে আসার ওপর...কিউবায় সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তান মৃত্যু হারের কথাই ধরা যাক : ২০০৮ সালে এই হার প্রতি হাজারে ৫-এর নিচে নেমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো হাইটেক প্রযুক্তি সক্ষমতা হয়তো আমাদের নেই, কিন্তু আমাদের সদ্যোজাত শিশু মৃত্যুর হার এসব দেশের তুলনায় কম, যার একটা কারণ হলো আমরা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সব গর্ভবতী নারী ও সদ্যোজাত শিশুর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। (সূত্র : ১৮) [লেখাটি Steve Brouwer লিখিত Revolutionary Doctors: How Venezuela and Cuba are changing the World's Conception of Health Care (২০১১, Monthly Review Press) শীর্ষক পুস্তকের Medicine in Revolutionary Cuba নামের অধ্যায়ের অনুবাদ।সর্বজনকথা ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটির অনুবাদক কল্লোল মোস্তফা] তথ্যসূত্র:

১. “Salud en Tiempo. 1970-2009”, Ministerio de SaludPublica, Cuba, 2010, http://files.sls.cu/dne/files/2010/11/salud-en-el-tiempo-2010.pdf. মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পরিসংখ্যানগুলো OECD এর তৈরী প্রতি হাজার নাগরিকের জন্য চিকিৎসকের হার থেকে সংগৃহীত। কিউবার প্রায় ২৫ শতাংশ চিকিৎসক দেশের বাইরে নিয়োজিত। ২. Ileana del Rosario Morales Suarez, MD, MS, Jose A. Fernandez Sacasas, MD, MS, and Francisco Duran Garcia, MD, “Cuban Medical Education: Aming for the Six-Star Doctor,” MEDICC Review, 10/4 (Fall 2008) ৩. পূর্বোক্ত ৪. পূর্বোক্ত ৫. Ernesto de la Torre Montejo, Saludparatodos, sies possible. La Habana: Sociedadcubana de SaludPublicaSeccion de Medicinia Social, 2004, 50. ৬. World Health Organization and the United Nations Children’s Fund, “Report of the International Conference on Primary Health Care, Alma-Ata, USSR, 6-12 September 1978,” WHO Health for All series, no. 1, Geneva, 1978. ৭. Primary Health care Comes Full Circle. An interview with Dr. Halfdan Mahler, Bulletin of the World Health Organization, October 2008. ৮. Howard Waitzkin, MD, PhD, Karen Wald, Romania Kee, MD, Ross Danielson, PhD, Lisa Robinson, RN, ARNP, “Primary Care in Cuba: Low and High-Tehnology Developments Pertinent to family Medicine,” Devision of Community Medicine, University of New Mexico, Family Practice Center, 1997. ৯. Morales Suarez et al., “Cuban Medical Education.” ১০. Lousi A. Perez Jr., Cuba: Between reform & Revolution, New York: Oxford University Press, 1988. ১১. “UNDP publishes Report on Human Development And Equity in Cuba,” MEDICC Review, 3/2(2000). ১২. ClarivelPresno Labrador, MD, MPH, and Felix Sanso Soberat, MD, “20 Years of family Medicine in Cuba,” MEDICC Review, 6/2(2004). ১৩. Andre-Jacques Neusy, kMD, and BjorgPalsottir, MPA, “A Roundtable of Innovative Leaders in Medical Education,” MEDICC Review, 10/4(Fall 2008). ১৪. Gail Reed, “Cuba’s Primary Health Care Revolution: 30 years on,” Bulletin of the World Health Organization 86(May 2008). ১৫. Indira A.R.Lakshmanan, “As Cuba Loans Doctors Abroad, Some Patients Object at Home,” Boston Globe, August 25, 2005. ১৬. Patricia Grogg, “CUBA: World Class Pharma that Puts People First,” International Press Service, December 1, 2009. ১৭. Figures for the year 2008, from World Health Organization, http: //www.who.int (accessed 2010) ১৮. Gail Reed, “Generating Appropriate Technologies for health Equity,” MEDICC Review 11/1(winter 2009).

Comments


Subscribe Form

©2020 by People's News Indie. Proudly created with Wix.com

bottom of page