করোনার প্রেক্ষাপটে লকডাউন: স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা
- People's News Indie
- Apr 4, 2020
- 5 min read
লকডাউনের এই মাঝামাঝি সময় এসে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং করোনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা চোখে পড়েছে সেইসম্পর্কে এই তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণটি লিখেছেন: উদ্ভাস দাস

(ছবি সংগৃহীত)
করোনা বা Covid-19 এর আতঙ্কে সারা বিশ্ব জর্জরিত। ভারতবর্ষে প্রথম করোনা ঢোকে 30 জানুয়ারীতে। কিন্তু তখনো অবধি এবং পুরো ফেব্রুয়ারী জুড়ে কেরালাতেই মোট 3টি কেস আসে, এবং সেই তিনজনেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। অবশেষে মার্চ এর 11 তারিখ WHO করোনাকে Pandemic হিসেবে ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে বলে রাখা ভালো যে মার্চ এর 13 তারিখ কেন্দ্র ঘোষনা করে দেয় করোনা ভারতবর্ষে স্বাস্থ্য সংকট নয়। ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং অবশেষে 19এ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাত্রি আট ঘটিকায় এসে উপস্থিত হন। আধঘন্টার ভাষণে তিনি মূলত এইটিই বলেন যে করোনা মোকাবিলা করতে আমরা আগামী 22এ মার্চ জনতা কারফিউ পালন করি। সেইদিন বিকেল 5টায় সকলে ব্যালকনিতে এসে পাঁচ মিনিটের জন্য থালা বাসন বাজান, এবং হাততালি দিন, স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে। অবশেষে সেই দিনে ভারতবাসী ঢাক ঢোল থালা খুন্তি শাঁখ কাসর ঘন্টা খালি সিলিন্ডার যা পায় মহোদ্যমে বাজাতে থাকে আধ ঘন্টার উপরে। অনেকে এতে দেশকে একত্রিত করার উদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছেন। যদিও এই তত্ত্বের কোনো ভিত্তি নেই। এর ঠিক দুই দিন পরে, আবার সন্ধ্যা আট ঘটিকায় মাননীয় আবির্ভাব হন এবং ঠিক চার ঘন্টা পর থেকে দেশ জুড়ে একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে দেন। বেশ কথা। অবশেষে উনি গতকাল আরেক প্রস্তাবনা আমাদের সামনে পেশ করেন: ৫-ই এপ্রিল রাত্রি নয় ঘটিকায়, নয় মিনিটের জন্য, আলো বন্ধ করে টর্চ, মোমবাতি, প্রদীপ জ্বালান। এটির কি উদ্দেশ্য তা ভালো করে ভক্তগণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবেন। এবং আগামীকাল, অর্থাৎ ৫-ই এপ্রিল রাত্রি নয়টায় ঠিক কি ঘটতে চলেছে তা সময়ই বলবে।
এই হলো মোটামুটি ভারতবর্ষের করোনা প্রেক্ষাপট। এর মধ্যে উল্ল্যেখ করে রাখা ভালো যে কয়েকদিন আগে পর্যন্তও আমি অনেক বামপন্থীকে করোনা-কে "মিডিয়া Hype", বা "মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা আক্রান্ত বলে অত্যাধিক প্রচার পাওয়া একটি রোগ" বলে নাকচ করে দিতে দেখেছি। বামপন্থীদের এই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ঘোর অবামপন্থী মনোভাবেরই নিদর্শন।
প্রধানমন্ত্রী সাহেব থালা বাজাতে তিন দিন আগে এসে বলে যান। অথচ 132.67 কোটির (ভারতবর্ষ মাইনাস কাশ্মীর এর জনসংখ্যা) ভারতবর্ষে লকডাউন ঘোষণা তিনি মাত্র চার ঘন্টা আগে এসে করে যান। এতে করে সারা দেশজুড়ে একটি অদ্ভুত প্যানিক সৃষ্টি করে এবং দেখা যায় যে যাদের ফুড কমান্ড (অমর্ত্য সেন এর ভাষায়) বেশি আছে (মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোক মূলত) তাঁরা হুড়মুড়িয়ে সেই খাদ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ মানুষ (নিম্নবিত্তরা) তা থেকে বঞ্চিত হন। বঞ্চিত হওয়ার কারণ এখানে ফুড Availability নয় শুধুমাত্র, মার্কেট ইকোনমির পলিসি অনুযায়ী ডিমান্ড হুহু করে বাড়াতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়াও অন্যতম কারণের মধ্যে পড়ে।
এছাড়াও ভারতবর্ষে মোট 139 মিলিয়ন (13 কোটি 90 লক্ষ) পরিযায়ী শ্রমিক আছেন। লকডাউন ঘোষণার পরে অনেক কাজের মালিক তাঁদের বাড়ি চলে যেতে বলেন, এবং বহু ক্ষেত্রে তাঁদেরকে বাড়িওয়ালারা বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেন। অধিকাংশ শহরে মাইগ্রেট করা শ্রমিকরা করোনা কে একটি বড়লোকের বিদেশ থেকে বয়ে আনা অসুখ মনে করেন এবং ভাবেন নিজেদের গ্রামে ফিরে গেলে তাঁরা নিরাপদ হবেন। তাঁদের মধ্যে বাড়ি ফেরার মারাত্মক রকম হুড়োহুড়ি পড়ে যায় এবং লকডাউন এত কম সময়ের নোটিসে ঘোষণার ফলে অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হাঁটা লাগান বাস বা অন্যান্য যানবাহনের অভাবে। অধিকাংশের কাছেই খাদ্য ছিল না, না ছিল পানীয় জল। এর মধ্যে অনেকে নিজের বাচ্চাদের কাঁধে নিয়ে শুরু করে দেন এই দীর্ঘ কয়েক-শ কিলোমিটার এর যাত্রা।
ভারতবর্ষের এক বড়ো সংখ্যক মানুষ, শিশুরা আজও খাদ্যাভাবে ভোগে। এই লকডাউন এর ফলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধারণ মানুষের হচ্ছে, সেটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত কারণ খাদ্যাভাব শুধুমাত্র খাদ্যের Availability-র অভাবে ঘটেনা, বরং এক্ষেত্রে তার উল্টোটাই সত্য। খাদ্যাভাব এই ক্ষেত্রে খাদ্যের উপর কমান্ড না রাখতে পারার কারণেই হচ্ছে (কমান্ড না রাখতে পারার এখানে অনেকগুলি কারণ আছে: খাদ্যের দাম ডিমান্ড বাড়ার কারণে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, বেকারত্ব, ইত্যাদি)।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে "State Intervention for Social Security" অত্যন্ত জরুরী। কেন্দ্রের তরফ থেকে একটা বড়সড় ত্রাণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া-র (FCI) এর স্টকে বর্তমানে ষাট মিলিয়ন টন (60,000,000 tonnes) খাদ্যশস্য মজুত করা আছে, যা Buffer Stock Norms এর চেয়ে তিন গুন বেশি। ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি Act (NFSA) এর দ্বারা পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS) এর মাধ্যমে অবিলম্বে এই স্টক ছাড়া হোক। NREGA শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেওয়া হোক, এবং Old Age পেনশন অবিলম্বে অন্ততঃপক্ষে ছ-মাসের দিয়ে দেওয়া হোক। এই কাজগুলি মানুষের সমস্যার সমাধান এর জন্য প্রয়োজনীয় তো বটেই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। উল্ল্যেখযোগ্য, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ত্রাণ হিসাবে 1 লক্ষ্য 70 হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করে। কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে, 2020-21 এর বাজেট এ এর মধ্যে অলরেডি 70 হাজার কোটি টাকা ছিলো। উপরি ত্রাণমূলক ব্যয় 1 লক্ষ্য কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা ভারতবর্ষের জিডিপির মোটামুটি 0.5% মাত্র। সেখানে সবরকম Energy Subsidy-র পিছনে খরচ মোটামুটি দেড় লক্ষ কোটি টাকা (2017 অনুযায়ী), এবং সামরিক খাতে ব্যয় জিডিপির 2.419% (2018 অনুযায়ী)। অনেকেই একে যথেষ্ট নয় বলে দাবি করেছেন। তাঁদের মতে এই সময়ে নূন্যতম জরুরি ব্যবস্থাগুলির জন্য যা দরকার, 1 লক্ষ 70 হাজার কোটি তার অর্ধেকের চাইতেও কম।
যেহেতু করোনা স্বাস্থ্যসংকট একটি বিশ্বব্যাপী মাত্রা ধারণ করেছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ে না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ভারতবর্ষের স্বাস্থ্য পরিকাঠামের বেহাল দশা। যে ভাইরাস সারা বিশ্বের তাবড় তাবড় স্বাস্থ্যব্যবস্থাসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলিকে নাজেহাল করে দিয়েছে, সেই ভাইরাস ভারতবর্ষে প্রবেশ করলে তা মোকাবিলা করা দুঃসহ হয়ে উঠতে পারে। এখানে দুইভাবে মোকাবিলার কথা ভাবা যেতে পারে। এক, স্টেজ 3, বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনকে রুখে দেওয়া। এটা ভারতবর্ষের মতো এত বড়ো দেশে প্রায় অসম্ভব। যেটা সম্ভব, সেটা হলো স্টেজ 3-কে যতটা সম্ভব স্লো করে দেওয়া। দুই, অবিলম্বে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি করা। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুইটিই অত্যন্ত জরুরি বলে আমার মনে হয়েছে। এটা ঠিক, যে আমাদের সরকার লকডাউন ঘোষণা করে প্রথম পদক্ষেপটা নিয়েছে। ইতালির সাথে তুলনা করলে তা বেশ আগে থাকতেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে কিন্তু স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে দেখতে গেলে জানুয়ারি 30 এর পরেই তৈরি হওয়া উচিত ছিল, এবং মার্চ এর 13 তারিখের ঘোষণা তো মোকাবিলার উল্টো রাস্তায় হাঁটা বলেই মনে হয়েছে। সে যাই হোক, পুরোনো ভুল ঘাঁটা হয়তো মোকাবিলার রাস্তা দেখাবে না। সুতরাং, এখন এই পর্যায় দাঁড়িয়ে, দ্বিতীয় পদক্ষেপটির প্রয়োজনীয়তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এইবারে সরকারের চরম ব্যর্থতা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।
প্রথমত এটা বলাই বাহুল্য যে ভারতবর্ষে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য দেশের মতো বেড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ হলো যথেষ্ট মাত্রায় টেস্টিং না হওয়া। প্রধানমন্ত্রী করোনার জন্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নতির ক্ষেত্রে 15 হাজার কোটি টাকার ঘোষণা করলেন। মাত্র, 15000 কোটি! এই দিয়েই কেনা হবে টেস্টিং কিট, PPE (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট), ভেন্টিলেটর, Isolation বেড, এবং অন্যান্য সরঞ্জাম। দেশজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা দাবি জানাচ্ছেন যে তাঁদের যথেষ্ট পরিমানে PPE নেই। নেই মাস্ক। রেইনকোট পরে আর মুখে কাপড়ের মাস্ক পরে (এটা Covid-19 এর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়) দিনরাত অবিরাম পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে। থালা বাজিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো জনসাধারণ ভাড়া বাড়ি থেকে ডাক্তার নার্সদের বের হয়ে যেতে বলছেন, কিছু জায়গায় ইঁট পাথর ও ছুঁড়েছেন। এবং থালা বাজাতে বলা সরকার বহু জায়গায় ডাক্তারদের বেতন কাটতে শুরু করে দিয়েছেন! এরই সাথে অনেকে হয়তো এটা বলতে পারেন যে সারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা। নেতামন্ত্ৰী, বহু কোম্পানির CEO-রাও পে কাট নিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় CEO, নেতামন্ত্রীরা কিস্যু কাজে আসবেন না। ত্রাতা হলে হবেন নূন্যতম প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব উপেক্ষা করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীরাই। সেখানে তাঁদের বেতন কমানো বা তাকে সমর্থন করা ঘোর অমানসিকতার পরিচয়ই দেয়। এখনো শেষ হয়নি। এই চরম সংকটের মধ্যেও ভারত সরকার 90 টন মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট Serbia-তে পাঠায়।
এতেও শেষ নেই। কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয় যাতে কোনো মিডিয়া সরকারি অনুমতি ছাড়া Covid-19 এর ব্যাপারে তথ্য বা খবর প্রচার না করে। ICMR (Indian Council of Medical Research) থেকেও করোনার তথ্য বার করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকেই সেই তথ্য বের হবে।
এবং সবশেষে, গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসে মোমবাতি জ্বালানোর বাণী দিয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে যান। এই সংকট ভারতবাসী কিভাবে কাটিয়ে উঠবে তা সময়ই বলবে। তবে সরকারের সিদ্ধান্তগুলি প্রদীপের শিখার চেয়ে তার নিচের অন্ধকারের দিকেই নির্দেশ করে। এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা ও কাজ স্ববিরোধী। এই মুহূর্তে ঘরে বসে আমার দেশবাসী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর অগাধ আশা রাখা ছাড়া উপায় নেই।
সূত্র:
1) Hunger and Public Action by Amartya Sen and Jean Dreze
2) https://www.cnbc.com/2020/01/30/india-confirms-first-case-of-the-coronavirus.html
3) https://www.weforum.org/agenda/2017/10/india-has-139-million-internal-migrants-we-must-not-forget-them/
4) https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/finance/indias-energy-subsidies-down-by-36-percent-to-rs-1-51-lakh-crore-in-fy-17/articleshow/67177941.cms
5) https://tradingeconomics.com/india/military-expenditure-percent-of-gdp-wb-data.html
6) https://www.ndtv.com/video/shows/reality-check/does-centre-s-coronavirus-package-for-poor-enough-544035
7) https://caravanmagazine.in/policy/no-one-should-be-condemned-to-starvation-jean-dreze
8) https://epaper.thehindu.com/Home/ShareArticle?OrgId=GAK79OFO4.1
9) https://www.bloombergquint.com/coronavirus-outbreak/as-government-denies-coronavirus-community-transmission-experts-say-too-few-tested-to-know
10) https://www.indiatoday.in/india/story/coronavirus-india-crore-allocated-to-strengthen-country-health-infrastructure-pm-narendra-modi-1659316-2020-03-24
11) https://www.livemint.com/news/india/covid-19-indian-gloves-export-to-serbia-causes-row-over-gear-shortage-11585805921730.html
12) https://www.deccanherald.com/national/centre-seeks-in-supreme-court-that-no-media-publish-covid-19-info-without-ascertaining-facts-with-govt-819695.html
13) http://emag.medicalexpo.com/which-masks-actually-protect-against-coronavirus/
Comments