top of page

প্রসঙ্গ: ভারতের জনসংখ্যা ও বিভেদের রাজনীতিকরণ 

  • Writer: People's News Indie
    People's News Indie
  • Apr 13, 2020
  • 5 min read


প্রসঙ্গ: ভারতের জনসংখ্যা ও বিভেদের রাজনীতিকরণ

লিখেছেন- শুভেন্দু মল্লিক

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ভারত বরাবরই চিন্তিত ছিলো এবং এখনও তা আছে। কিন্তু তাতে বর্তমান সময়ে ( বিশেষ করে ২০১৪ সালের থেকে ) একটা নতুন পালক যোগ হয়েছে, আর সেটা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা এবং তার উপর সব দায় চাপিয়ে দয়ে তাকেই দোষিসাব্যস্ত করা এবং তা নিয়ে ভেদাভেদের রাজনীতি করা। আর এজন্যই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা যে নাগপুর হেডকোয়াটার থেকে পরিচালিত হয় সেই হেডকোয়াটারের দীর্ঘদিনের দাবি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী। আর এজন্য তারা দু'ই সন্তানের নীতির কথাও ঘোষণা করেছে। এই একই সুর গত বছর ১৫-ই আগস্টের লালকেল্লার ভাষণ থেকেও শোনা গেছিলো। তাতে টার্গেট সেই একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়। এই উভয়েরই মূল দাবি ওই একটিমাএ ধর্মীয় সম্প্রদায়ই এদেশে জনবিস্ফরণের জন্য দায়ী এবং এদের জন্যই দেশের অর্থনীতির হাল খারাপ ( বর্তমানে দেশের অর্থনীতি হাল কি তা সকলেরই জানা )। একই সঙ্গে ওই উভয়েরই দাবী এইভাবে যদি ওই নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায় জনসংখ্যায় বাড়তে থাকে তাহলে তারা একদিন আবারও ( সুলতানি ও মোঘল আমলের মতো ) এদেশ শাসন করবে এবং তাতে আমরা তর্থাৎ হিন্দুরা তাদের শোষকে পরিনত হবো, তাই আমাদের অর্থাৎ হিন্দুদের উচিত বেশী করে সন্তান নেওয়া ও হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতীষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এদের কথাতেই দ্বিচারিতা লক্ষ্যণীয় তারা একবার গোটা ভারতজুড়ে দু'ই সন্তানের নীতির কথা বলছে আবার এরাই নিজেদেরকে অসুরক্ষিত মনে করে নিজেদের সম্প্রদায়কে বাড়ানোর জন্য নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকেদেরকে বেশী করে সন্তান নেওয়ার কথা বলছে। এবং একই সাথে এরা লোকের ব্যাক্তিস্বাধিনতায়ও পূর্ণমাত্রায় হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু এরাই ভুলে যাচ্ছে যে এদের সময়ের পিতা-মতাদের এক এক জনের সন্তান কম করে ৫ জন ছিলো এবং তা আবার এক এক জনের ক্ষেত্রে মাত্রা এতোটাই ছাড়িয়ে যেতো যে তা ১০ জনের ঘর অবদিও পেরিয়ে যেতো। ফলে দেখা দিতো শিশুর অকাল মৃত্যু এবং মায়েদের শারীরিক দূর্বলতা ও কখনও কখনও মৃত্যু। তার পরের প্রজন্মের ক্ষেত্রে এই মাত্রা কিছুটা কম হলেও খুব বেশী তফাত হয়নি ( আমাদের বাবা-মায়েদের কথা বলছি )। তা এই বিপুল পরিমাণ সন্তান নেওয়া এরা সকলেই কিন্তু হিন্দু ছিলো। অতয়েব মুসলিমরাই যে শুধুমাত্র এদেশে জনসংখ্যা বাড়িয়েছে তা একদমই নয়। তাতে উভয়েরই অবদান আছে। তখন এদেশে জনসংখ্যা ক্রম বৃদ্ধির কারণছিলো অশিক্ষা এবং দারিদ্রতা। আজকের দিনে বাবা-মা তার সন্তানকে যেভাবে দেখে তখনকার দিনে সন্তানকে তার বাবা-মায়েরা এই চোখে দেখতো না, তারা সন্তানকে দেখতো অর্থ উপার্জনের চোখ দিয়ে, তাই একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যাদের যাদের সন্তান বেশী বেশী ছিলো তারা হয় অশিক্ষিত ছিলো না হয় তারা দারিদ্র ছিলো ( হাতে গোনা দু'একজনের কতা বাদে, যাদের শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও বহু সন্তানের অধিকারি ছিলো )। তাই সন্তান বহু থাকাকে ভেদাভেদের নিরিখে না দেখে অশিক্ষা এবং দারিদ্রতার নিরিখেই দেখা ভালো এবং তাতে আগামী ভারত গঠনে অনেক, অনেক বেশী সুবিধা হবে। এবার দেখে নেওয়া যাক ভারতে জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির ডেটা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে যেভাবে গোটা ভারত জুড়ে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কি আদৌও ভারতের চিন্তার কারণ ? গত জুলাইয়ে জারি হওয়া কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রকের আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট আবার উল্টো কথা বলছে, তারা বলছে গোটা দেশে জন্মের হার কমছে। তার ফলে দেশের জনসংখ্যায় বয়স্কদের হার বেড়ে যাচ্ছে। মহিলারা মাথা পিছু গড়ে যত জন সন্তানের জন্ম দেন, তাকেই জন্মের হার বলে। নিয়ম বলে, এদেশে জন্মের হার ২.১ হলে জনসংখ্যা একই থাকবে। কিন্তু আর্থিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ২০২১ এই জন্মের হার ১.৮ শতাংশে নেমে আসবে যা ভীষণই উদ্বেগের বিষয়। এতে আজকের ইয়ং ভারত বয়স্ক ভারতের দিকে এগোতে থাকবে। আবার প্রতিটি জনগণনাতেই দেখা যাচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমছে। আর এখানে যদি নাগপুরের নীতিকে কর্যকর করে দুই সন্তানের নীতি বহাল করতে হয় তাহলে এদেশে পুএ সন্তান নেওয়ার প্রবণতা এখনের তুলনায় আরও বাড়বে এবং একই সঙ্গে বাড়বে মাতৃত্বকালীন সন্তান নির্ধারণের ব্যাবসা। এবার তথ্যের নিরিখে দেখে নেওয়া যাক ভারতের জনসংখ্যাগত দিক। ভারতের বর্তমান ( ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী ) মোট জনসংখ্যা ১২১.০৯ কোটি। ২০০১ থেকে ২০১১-র মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১৭.৭ শতাংশ। ভারতে মোট হিন্দু জনসংখ্যা ৯৬.৬৩ কোটি। অর্থাৎ ভারতের মোট জনসংখ্যা ৭৯.৮ শতাংশ। ভারতে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ১৭.২২ কোটি, যা ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৪.২ শতাংশ। একইভাবে খ্রিষ্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মাবলম্বি জনসংখ্যা ২.৭৮ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ ), ২.০৮ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ১.৭ শতাংশ ), ০.৮৪ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ০.৭ শতাংশ ), ০.৪৫ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ০.৪ শতাংশ )। এছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বিরা আছে ০.৭৯ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ০.৭ শতাংশ )। আর যারা নিজেদেরকে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না যারা মানবধর্মের কথা বলে তাদের সংখ্যা ০.২৯ কোটি ( মোট জনসংখ্যার ০.২ শতাংশ )। হিন্দু এবং মুসলিম জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি হার দেখে নেওয়া যাক। ১৯৫১-'৬১ হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ৩৬.৬৫ কোটি, হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ২০.৭৬ শতাংশ। একইভাবে এই এক দশকে মুসলিম মোট জনসংখ্যা ছিলো ৪.৬৯ কোটি, আর জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ৩২.৪৯ শতাংশ। আবার, ১৯৬১-'৭১ মোট হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ৪৫.৩৩ কোটি এবং জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ২৩.৬৮ শতাংশ। এই দশকেই মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো ৬.১৩ কোটি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ৩০.৯২ শতাংশ। ১৯৭১-'৮১ এই এক দশকে হিন্দু মোট জনসংখ্যা ছিলো ৫৬.২৪ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ২৪.০৭ শতাংশ। এই দশকেই মুসলিম মোট জনসংখ্যা ছিলো ৮.০৩ কোটি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ৩০.৭৮ শতাংশ। ১৯৮১-'৯১ এই একদশকে হিন্দু মোট জনসংখ্যা ছিলো ৬৯.০১ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ২২.৭১ শতাংশ। এই দশকে মুসলিম মোট জনসংখ্যা ছিলো ১০.৬৭ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ৩২.৮৮ শতাংশ। ১৯৯১-২০০১ এই এক দশকে মোট হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ৮২.৭৬ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ১৯.৯২ শতাংশ। এই এক দশকে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো ১৩.৮২ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ২৯.৫২ শতাংশ। ২০০১-২০১১ এই এক দশকে মোট হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ৯৬.৬৩ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ১৬.৭৬ শতাংশ। এই এক দশকে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো ১৭.২২ কোটি, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিলো ২৪.৬০ শতাংশ। ( অতয়েব জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে উভয়েরই সংখ্যা লাগাতার ভাবেই বেড়েছে )। ২০০১-২০১১ তে খ্রিষ্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৫.৫%-৮.৪%-৬.১%-৫.৪%। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে ১৯৬১-'৭১ এই দশকে হিন্দু জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশ বেড়েছে, এই দশকে মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারও ২.৪৩ শতাংশ বেড়েছে। আবার ১৯৭১-'৮১ এই দশকে ১.৬১ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যার হার বেড়েছে এবং ০.১৪ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমেছে। একইভাবে ১৯৮১-'৯১ এই দশকে ২.৬৪ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমেছে এবং ২.১০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার বেড়েছে। ১৯৯১-২০০১ এই দশকে ৩.২১ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যবৃদ্ধির হার কমেছে এবং ৩.৩৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারও কমেছে। ২০০১-২০১১ এই দশকে ৩.১৬ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমেছে এবং ৫.১২ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমেছে। অতয়েব তথ্যের নিরিখে উভয় সম্প্রদায়ই ভারত সরকারের আর্থিক সমীক্ষা অনুসারে ঘোর বিপদের মুখোমুখি। আগের তুলনায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার হ্রাসের কারণ শিক্ষার ক্রমবিকাশ। শিক্ষার ক্রমবিকাশ যখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হচ্ছে ঠিক সেই সময় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এক ভুল তথ্য হাজির করে কৃএিম বিভেদ তৈরি করছে নাগপুরের হেডকোয়াটার। তারা ইয়ং ভারতকে বয়স্ক ভারতে পরিণত করতে চাইছে। নারী-পুরুষ অনুপাতও বেড়েছে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রতি ১০০০ মুসলিম পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ছিলো ৯৩৬ তা ২০১১-তে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫১-এ। আবার ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রতি ১০০০ হিন্দু পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা ছিলো ৯৫৪ তা ২০১১-তে বেরে দাঁড়িয়েছে ৯৭৮-এ। এই নারী বৃদ্ধির হার নাগপুরের হেডকোয়াটারের কাছে খুবই খারাপ খবর কেননা, তারা প্রচন্ডভাবেই নারী বিদ্বেষী। যাইহোক, জনগণনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন শিক্ষার হার বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি পরিবার পরিকল্পনায় প্রভাব পড়ে ফলে, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান যেই হোক না কেনো তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়তে থাকলে এবং আয় বৃদ্ধি পেতে থাকলে জন্মের হার এমনিতেই কমে যাবে। ফলে রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষার বিস্তার করা এবং আয় বৃদ্ধি করা নাকি নাগপুরের হেডকোয়াটারের মন গড়া দুই সন্তান নীতি গ্রহণ করা ? যার পেছনে আছে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, ধর্মীয় ভেদাভেদ, ধর্মীয় আগ্রাসণ, ধর্মীয় অন্ধত্ব, ধর্মীয় গোড়ামী, ধর্মতন্ত্র নেই কোন বিজ্ঞানসন্মত যুক্তি ও তথ্য। তাই জনসংখ্যাকে বিকৃতভাবে পেশ করে যে ধর্মীয় ভেদভেদ, ধর্মীয় হিংসা এবং ধর্মীয় অবিশ্বাস তৈরি করা হচ্ছে তা আগামীদিনে ব্যাক্তি-সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এতেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে মৌলবাদী শক্তি এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তি, যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে ভয়াভয়। তাই ব্যাক্তি-ব্যাক্তির শিক্ষা-সমাজ-সমাজনীতি-রাষ্ট্র-রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির স্বার্থে যেকোন প্রকার ধর্মীয় বিভেদের উদ্ধে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে।

Comments


Subscribe Form

©2020 by People's News Indie. Proudly created with Wix.com

bottom of page