হালিমা, রাজিয়ার কথা —শর্মিষ্ঠা চৌধুরী
- People's News Indie
- Jun 14, 2021
- 4 min read
খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্ত হালিমা, রাজিয়াকে নিয়ে লেখাটি বেশ কিছুমাস আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে চূড়ান্ত আক্রমনের মুখে পড়েছিলেন সদ্য প্রয়াত, নকশালপন্থী রাজনৈতিক কর্মী, ভাঙর পাওয়ারগ্রীড বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, সিপিআই (এমএল) রেডস্টারের পলিটব্যুরো সদস্যা কমরেড শর্মিষ্ঠা চৌধুরী। শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার, নারী অধিকার, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। তাঁর অকাল মৃত্যু বিপ্লবী রাজনীতির এক অপূরণীয় ক্ষতি।

জেলে আমার সঙ্গে ছিল হালিমা আর রাজিয়া। ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের কথা মনে আছে তো? সেই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত হালিমা আর রাজিয়া -- দুজনেরই ২০-র কোঠায় বয়স, প্রাণোচ্ছল, ধর্মভীরু দুটি মেয়ে। হালিমা যখন গ্রেপ্তার হয় তখন ও অন্তঃসত্ত্বা, ছেলে ইব্রাহিমের জন্ম হয় জেলে। আর রাজিয়া কয়েক মাসের শিশুকন্যা সাদিয়াকে নিয়ে জেলে আসে।
ওরা দু'জন, বাচ্চা সহ, থাকত একটা অন্ধকার, স্যাঁতসেতে, আলো-বাতাসহীন ঘরে। সঙ্গে 'মেট', যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নমিতাদি। জেলে ঢোকার পরই আমার প্রথম কৌতূহল হয়েছিল, ওরা দু'জন আলাদা একটা ঘরে থাকে কেন? অন্য সবাই তো ওয়ার্ডে থাকে। সহবন্দীরা আমায় সোৎসাহে আলোকিত করেছিলেন, "আরে, ওরা তো সন্ত্রাসবাদী। ওদের সঙ্গে কারও কথা বলা বা মেশা বারণ।"
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ। নিষিদ্ধ যখন, তখন ওদের সাথে তো মিশতেই হবে। মাওবাদী নেত্রী কল্পনা মাইতি আমার মাসখানেক আগে আলিপুর জেলে আসায় ও হালিমা-রাজিয়াদের সাথে প্রাথমিক আলাপ পরিচয়টুকু সেরে রেখেছিল। কিছু মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানোর চেষ্টাও করেছিল। এবার এসে জুটলাম আমি। আর আমাদের চারজনের বেশ জমাটি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমাদের আগে হালিমা-রাজিয়ার সাথে কেউ কথা বলত না, ফলে আমাদের পেয়ে ওরাও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।
লক-আপের বাইরের সময়টা আমরা গল্প করে কাটাতাম। হালিমা আর রাজিয়া মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার গ্রামের মেয়ে। সাধারণ, ধর্মপ্রাণ, যেমন হয় আরকি। খাগড়াগড় কান্ডের সাথে ওদের যতটুকু যোগাযোগ পুরোটাই ওদের স্বামীদের সূত্রে। এককথায় বলতে গেলে, ওরা গ্রেপ্তার হয়েছিল কারণ ওরা খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্তদের স্ত্রী ছিল। এই ধরনের বন্দীদের আদৌ রাজনৈতিক বন্দী বলা যায় কি না, তা নিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যেই বিতর্ক আছে। ফলে এদের অবস্থা হয় সবচেয়ে শোচনীয়। এরা আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজনৈতিক বন্দীর স্বীকৃতি তো পায়ই না, সামাজিক ভাবেও সেই স্বীকৃতি পায় না। আবার সাধারণ বন্দীরাও এদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে না। ফলে এরা, বিশেষ করে এদের মধ্যেকার নারী বন্দীরা, জেলের ভেতর হয়ে পড়ে সবচেয়ে অসহায়, নিঃসঙ্গ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, বিতর্ক যাই থাক, আমি যতদূর জানি খাগড়াগড় কান্ডে অভিযুক্তদের আইনি সহায়তা পেতে এপিডিআর ও বন্দীমুক্তি কমিটি সাহায্য করেছিল।
হালিমা-রাজিয়াদের অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম। ওদের জন্য বরাদ্দ হল সলিটারি কনফাইনমেন্ট, অন্যদের সাথে মেলামেশায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে আহত হয়ে রাজিয়ার স্বামী হাসপাতালে পুলিশ কাস্টডিতে মারা যায়। সদ্য বিধবা তরুণী। কোলে দুধের শিশু। বাইরের জগতের অভিজ্ঞতা খুবই কম। জেলে আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই ওর বাবার মৃত্যুসংবাদ আসে। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে রাজিয়া। রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যায়। ওর অবস্থা দেখে জেলের ওয়েলফেয়ার অফিসার পরামর্শ দেন সেলাইয়ের কাজে যুক্ত হতে, তাতে মনটা একটু ভাল থাকতে পারে।
জেলে একটা 'সেলাই ঘর' ছিল। সেখানে বন্দীরা জড়ো হয়ে সেলাই করত, মেশিনে সালোয়ার কামিজ, নাইটি, ইত্যাদি বানাত। এমব্রয়ডারির কাজ করত। ওদের তৈরি জিনিসগুলো জেলের ভেতর বন্দীদের মধ্যেও বিক্রি হত, আবার বাইরেও বিক্রির জন্য পাঠানো হত।
জেল কর্তৃপক্ষ বেঁকে বসল। রাজিয়া যদি সেলাই ঘরে গিয়ে সবার সঙ্গে সেলাই করে তাহলে তো ওর প্রভাবে সবাই 'সন্ত্রাসবাদী' হয়ে যাবে। অতএব ওয়েলফেয়ার অফিসারের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।
এরমধ্যে হালিমার বাচ্চা হওয়ার সময় এগিয়ে এল। ও ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ল। জন্ডিস। কিন্তু জেলে চিকিৎসা হল নাম-কে-ওয়াস্তে। শেষে কোর্টে আবেদন করে হালিমার সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হল, ওর ছেলে হল। হালিমার স্বামীও একই কেসের আসামি, ছিলেন আলিপুর ছেলেদের জেলে।
হালিমা-রাজিয়াদের জেলের মাঠে হাঁটা নিষেধ ছিল। ওরা বড়জোর ওদের কুঠুরির ঠিক বাইরে দু-চার পা হাঁটার অধিকার পেয়েছিল। কল্পনা-আমি আসার পর ওদের জোর করে নিয়ে হাঁটতে বেরোতাম। আমাদের মনোভাব ছিল, কেউ কিছু বলতে আসলে দেখে নেব। যাইহোক, কর্তৃপক্ষ আমাদের ঘাঁটায়নি। ফলে জেলে ঢোকার সওয়া দু'বছর পরে হালিমা-রাজিয়া প্রাণ ভরে হাঁটতে পেরেছিল।
আলিপুর মেয়েদের জেলে একটা বেশ বাহারি ডাইনিং হল ছিল। সেখানে ওয়ার্ড অনুযায়ী, ব্যাচ করে বন্দীরা দুপুরের খাবার খেতে যেত। হৈ-হল্লা হত। "আরেকটু তরকারি দাও," "ডালটা এত থকথকে কেন যে বানাও!", এইসব চলত। জেলের বিস্বাদ তরকারির সাথে বাড়ির আচার ভাগ করে খাওয়া চলত। সবমিলিয়ে একটা হইচই ব্যাপার থাকত, সেটাই বন্দীদের কাছে বিনোদন, মনোরঞ্জন। কিন্তু হালিমা-রাজিয়াদের ডাইনিং হলে গিয়ে সবার সঙ্গে খাওয়া নিষেধ ছিল। পাছে ওদের সংস্পর্শে এসে জেলসুদ্ধ সবাই 'সন্ত্রাসবাদী' হয়ে যায়! ওদের 'মেট' ওদের অন্ধকার কুঠুরিতে খাবার নিয়ে আসত। ওরা ওই অস্বাস্থ্যকর ঘরের ভেতরে বসেই খেত।
জেলে গরমের সাথে সাথে মশার দৌরাত্ম্য বাড়ল। আগেই বলেছি ওদের কুঠুরিটা কী প্রচন্ড অস্বাস্থ্যকর। মশার কামড়ে বাচ্চাদুটো রাত্রে ঘুমাতে পারে না। হালিমা-রাজিয়া একটা মশারির জন্য জেল সুপারের কাছে আবেদন করল। সুপার বললেন, কোনও বন্দীরই মশারি নেই, তোমরা কোন্ কেউকেটা যে তোমাদের মশারি দিতে হবে? রাজিয়া সপাটে জবাব দিল, "আমরা অবশ্যই অন্য সব বন্দীদের থেকে আলাদা। সেটা বোঝাতেই তো আপনি অন্যদের আমাদের সাথে কথা বলতে পর্যন্ত নিষেধ করে রেখেছেন।" শেষে ওরা মশারির জন্য কোর্টে আবেদন করল, এবং কোর্ট তা মঞ্জুর করল। যেদিন ওরা সুপারের ঘর থেকে মশারি নিয়ে এল, সেদিন আমাদের কী যুদ্ধজয়ের আনন্দ।
ওদের কেসের ব্যাপারে কথা হত। জানতে পারলাম ওদের ফোনে যাদের নম্বর সেভ করা ছিল, সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা খোঁজা চলছে। পাড়ার নির্দোষ দোকানদার, ডাক্তার সব গ্রেপ্তার হয়েছিল কারণ হালিমা বা রাজিয়ার ফোনে ওদের নম্বর সেভ করা ছিল। পরে অবশ্য তাদের মধ্যে অনেকে জামিন পায় বা খালাস হয়ে যায়। খাগড়াগড় কেস এনআইএ-র অধীনে ছিল। সহস্রাধিক পাতার চার্জশীট, কয়েক শো সাক্ষী। ইউএপিএ, দেশদ্রোহিতা সহ বিভিন্ন কঠোর ধারায় মামলা। যে মামলা সাধারণ গতিতে চললে ২০ বছরেও ফয়সালা হওয়া মুশকিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কী হবে মনে হয়?" নিষ্পাপ মুখে জবাব দিয়েছিল, "আল্লা যা চাইবে, তাই হবে।"
গত বছর আগস্ট মাসে খবরের কাগজ পড়ে জানলাম, মামলা চলাকালীন হালিমা-রাজিয়া সহ খাগড়াগড় কান্ডে অভিযুক্ত ১৯ জন বন্দী আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। ওদের আইনজীবী আদালতে জানিয়েছেন যে ওরা সবাই সমাজের মূলস্রোতে দ্রুত ফিরতে চায়, চায় না বছরের পর বছর ধরে মামলা চলুক। আদালত যেন ওদের আবেদন বিচার করে সাজা দেয়।
তার দু'দিন বাদে খবর বেরোল যে ওই ১৯ জনকে সাজা শোনানো হয়েছে। হালিমা ও রাজিয়ার যেহেতু বয়স কম, ছোট বাচ্চা আছে, এবং এটা ওদের প্রথম অপরাধ, তাই সবদিক বিচার করে ওদের ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। ওরা যে-যে ধারায় অভিযুক্ত, তাতে আইনত ওটাই সর্বনিম্ন সাজা। ৬ বছরের মধ্যে ওদের প্রায় সাড়ে চার বছর জেল খাটা হয়ে গেছে, তাই খুব দ্রুতই ওরা সাজা শেষ করে জেল থেকে বেরোতে পারবে।
আমি জানি না, ওরা করোনাপর্বে জামিন বা প্যারোল পেয়েছে কি না, না কি এখনও জেলেই আছে, সাজা খাটছে। জানি না ওরা কেমন আছে। কিন্তু গতকাল সারাদিন ওদের কথা ভেবেছি।আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন অযোধ্যায় ভূমি পুজো করলেন, বললেন সংবিধান হত্যার ওই মুহূর্তটা নাকি কোটি কোটি ভারতবাসীর কাছে এক 'আবেগঘন' মুহূর্ত, কারণ রাম এত বছর পর স্বমহিমায়, স্বগৃহে ফিরছেন, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটালেন, তখন কোথায় ছিল হালিমা আর রাজিয়া? জেলে, নাকি বাড়িতে? ওরা কি টিভি দেখছিল, বা রেডিও শুনছিল? হিন্দু আধিপত্যবাদের রাষ্ট্রীয় আস্ফালন কি ওদের ভীত করছিল, কুঁকড়ে দিচ্ছিল? দেশের গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখে যে মূলস্রোতে ফেরার প্রতিশ্রুতি ওরা আদালতকে দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভূমি পুজো যে সেই 'মূলস্রোত' থেকে ওদের এবং ওদের সম্প্রদায়ের সবাইকে এক ধাক্কায় বিতাড়িত করে দিল, আনুষ্ঠানিক ভাবে 'অপর' করে দিল -- এই রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসঘাতকতার সামনে দাঁড়িয়ে ওরা কী ভাবছিল?
Comentarios